ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) যেন দুর্নীতির এক আখড়ায় পরিণত হয়েছে। কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যক্তিস্বার্থে প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যবহার করছেন নগ্নভাবে। এর নেতৃত্বে রয়েছেন ডিপিডিসির শ্রমিক লীগের নেতা মো. জসিম উদ্দিন। যিনি ডিপিডিসির বনশ্রী ডিভিশনের একজন সিনিয়র সহকারী হিসাব কর্মকর্তা। অনিয়ম ও দুর্নীতি করে বার বার পার পেয়ে যাওয়া এই জসিম এখন শত কোটি টাকার মালিক। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা দালালচক্রের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি হুমকির মুখে পড়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে উঠে এসেছে ভয়াবহ সব অভিযোগ। সরকার পরিবর্তনের পর এখনো কীভাবে এই দুর্নীতিবাজ তার সাম্রাজ্য টিকিয়ে রেখেছেন, তা নিয়েও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। প্রশ্ন উঠেছে, গণমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশের পরও ফ্যাসিবাদের দোসর এই কর্মচারী কীভাবে স্বপদে বহাল রয়েছেন? জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে, নাকি রাজনৈতিক ব্যাকআপেই পার পেয়ে যাবে সে? তা নিয়েও ডিপিডিসিতে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা।
ডিপিডিসি সূত্র জানিয়েছে, প্রধান কার্যালয়ের হিসাব বিভাগের উচ্চপদস্থ এক কমকর্তা জসিমের নিকটাত্মীয়। পাশাপাশি এইচ আর বিভাগের একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তার প্রশ্রয়ও পাচ্ছেন তিনি। আর এ কারণেই এত অনিয়ম করার পরও বহাল তবিয়তে রয়েছেন জসিম।
জানা যায়, ২০০৮ সালে লাইনম্যান ম্যাট পদে চাকরি শুরু করেন মো. জসিম উদ্দিন। ধাপে ধাপে পদোন্নতি পেলেও তার সবচেয়ে বড় ‘যোগ্যতা’ ছিল—রাজনৈতিক প্রভাব, দালালি আর দুর্নীতিকে পুঁজি করে প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বের করে নেওয়া। বর্তমানে তিনি বনশ্রী ডিভিশনের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাকাউন্টেন্ট। তবে কাগজে কলমে এই পরিচয় হলেও বাস্তবে তিনি ডিপিডিসির একটি দুর্নীতি সিন্ডিকেটের প্রধান।
তার নেতৃত্বে থাকা চক্রটি এখনো ডিপিডিসির ৩৬টি ডিভিশনে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। উচ্চচাপ সংযোগের সাবস্টেশনের স্থাপনে ঠিকাদারি চুক্তি নেয়া, গ্রাহককে বিভিন্ন ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায়, নিয়মবহির্ভূতভাবে উচ্চচাপ সংযোগকে পাশ কাটিয়ে নিম্নচাপ সংযোগ দিয়ে টাকা কামানো, গ্রাহকের আঙ্গিনায় সোলার প্ল্যান্ট স্থাপনের ঠিকাদারি নেয়া থেকে শুরু করে হেন কোন অনিয়ম নেই যা করে তিনি টাকা কামাচ্ছেন না। তার এই অপকর্মে সক্রিয়ভাবে যুক্ত রয়েছে সহকারী প্রকৌশলী আতাউর রহমান প্রামাণিক, উপসহকারী প্রকৌশলী আসিফ মাহমুদ এবং দালাল শামীম, মুজিবর ও সোহেল।
বনশ্রী ডিভিশনের এক প্রকৌশলী জানান, শুধু এই ডিভিশনেই নয়, জসিমের নেতৃত্বে সিন্ডিকেটের সদস্যরা এখনও পুরো ডিপিডিসি দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে।
জসিম উদ্দিন শুধুই একজন কর্মকর্তা নন, তিনি এখন বনশ্রী বিল্ডার্স নামে একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মালিক। তার অফিস বনানীর ইউনাইটেড বেনিসন ভবনে এবং আরেকটি কার্যালয় রামপুরার হক টাওয়ারে। তিনি বিদ্যুতের সাবস্টেশন নির্মাণ, সোলার প্লান্ট, পিএফআই প্লান্ট—সবখানেই তার ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব রয়েছে। মাসে মাসে লাখ লাখ টাকা আয় হচ্ছে এসব অবৈধ ব্যবসা থেকে। এভাবেই আওয়ামী শাসনামলে শত কোটি টাকার মালিক বনে যান জসিম।
তার সম্পদের উৎস এবং দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মাঠে নেমেছেন। দুদকের উপপরিচালক মো. মাহাবুব মোর্শেদ স্বাক্ষরিত আদেশে ডিপিডিসি থেকে চাওয়া হয়েছে তার চাকরির যাবতীয় নথি, আয়-ব্যয়ের হিসাব এবং ব্যক্তিগত তথ্যাদি।
সূত্র জানায়, জসিম উদ্দিন অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন, যারাই তার দুর্নীতির প্রতিবাদ করেছেন, তাদের চাকরি খেতে উঠেপড়ে লাগতেন। কাউকে ‘রাজাকার’ বলে অপমান করতেন, আবার কাউকে শারীরিকভাবে হুমকি দিতেন। তিনি প্রভাব খাটিয়ে চেয়ারম্যান, এমডি কিংবা শীর্ষ কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে কাজ করাতেন। এখনও তিনি তাই করছেন। বর্তমান সরকারের আমলেও তিনি কীভাবে তার স্বৈরাচারি মনোভাব নিয়ে ডিপিডিসিতে টিকে আছেন তা নিয়ে চলছে নানা সমালোচনাও। কেউ বলছেন, এই আমলের লোকদেরকেও টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে পুরনো আমলের মত কাজ করে যাচ্ছেন জসিম।
অভিযোগের বিষয়ে সহকারী প্রকৌশলী আতাউর রহমান প্রামাণিক বলেন, কোনো অনিয়মের সঙ্গেই আমি জড়িত নই। জসিমের বিষয়টি ভিন্ন। আমার নির্বাহী প্রকৌশলী ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বললে বুঝতে পারবেন, আমি কতখানি সৎ!
উপসহকারী প্রকৌশলী আসিফ মাহমুদ বলেন, আমরা প্রকৌশল বিভাগে কাজ করি। এখানে সচরাচর অনিয়ম করার কোনো সুযোগ নেই। জসিমের বিষয়টি আমি শুনেছি। তবে তার কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা নেই। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর অফিস ভবনের (বনশ্রী অফিস) বাইরে স্থানীয় পর্যায়ে অনেক দালালরাই এখন সক্রিয়।
বনশ্রী ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আনিস রহমান সোমবার (২৬ মে) বাংলা স্কুপকে বলেন, জসিমের দুর্নীতি তদন্তে দুদক নথিপত্র নিয়েছে। এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। অপর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, অন্তর্বতী সরকারের ন্যায় বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অন্যান্য পরিচালকরাও দুর্নীতির ব্যাপারে জিরো টলারেন্সে রয়েছেন। সেই জায়গা থেকেই বলছি, এখানে দায়িত্ব নেয়ার পর আমি ও আমার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (এসি) গ্রাহক হয়রানি রোধে জিরো টলারেন্সে রয়েছি।
এ বিষয়ে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অ্যাডমিন ও এইচআর) সোনামণি চাকমা বাংলা স্কুপকে সোমবার (২৬ মে) বলেন, সরকার দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। ডিপিডিসির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক দুর্নীতি ও গ্রাহক হয়রানির বিরুদ্ধে কঠোর। কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা গ্রহণে কোন ছাড় নেই। জসিমের বিষয়টি যেহেতু দুদক তদন্ত করছে, এখানে আমি কোন মন্তব্য করতে চাই না।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জসিমের সঙ্গে কোনো প্রকৌশলীর যোগসাজশ থাকলে খতিয়ে দেখে দ্রুতই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিপিডিসির একজন উর্ধ্বতন কর্মকতা বাংলাস্কুপকে বলেন, জসিম উদ্দিন একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসেবে ডিপিডিসির সর্বমহলে পরিচিত। সংযোগ নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পকেট ভারী করা, রাজনৈতিক প্রভাব দেখিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতির আশ্রয়ে গড়ে তোলা তার সাম্রাজ্যকে এখনই ধ্বংস করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিপিডিসির এক কর্মকর্তার দুর্নীতির চিত্র স্পষ্টভাবে দেখায়, কীভাবে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট নিয়মনীতি উপেক্ষা করে সাধারণ গ্রাহকদের হয়রানি করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। দুদকের অনুসন্ধান ও ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই দুর্নীতির জাল ছিঁড়ে ফেলা এখন সময়ের দাবি।
বাংলা স্কুপ/প্রতিবেদক/এনআইএন/আরএইচ/এসকে
বিদ্যুতের সেই জসিমের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে দুদক
আলাদিনের চেরাগ!